আবার যদি জন্ম নিতাম

আবার যদি জন্ম নিতাম

দুশো বছর আগে জন্ম নিতে পেরে আমি সহজেই দশের এক হতে পেরেছিলাম , দু’শ বছর পরে জন্মালে আমি হয়তো তোমাদের কাছে অপাংক্তয় , অপ্রাসংগিক হয়ে পড়তাম । আজ যে তোমরা এতো আদর যত্ন করছো ? ফুলের মালায় ভরিয়ে দিচ্ছো ? কত শত বাক্ বিন্যাসে কবিতা গানে প্রশংসা করছো ? – এতো আমার পরম সৌভাগ্য ! ক’ জনের ভাগ্যে জোটে এমন সম্মান ? ভাগ্যিস জন্মে ছিলাম সে যুগে ! যখন বর্ণাক্ষর জ্ঞানের জন্য পাঠশালা যাওয়ার তাগিদ ছিল না মানুষের ! কবিগান , টপ্পা খেউর শুনেই রাত কেটে যেতো মহা আনন্দে , কিসের জন্য শিখতে যাবে লেখাপড়া! তবুও কী জানি মনে হলো , দেশের মানুষগুলো কী কুকুর বিড়ালের মত জীবন কাটাবে ? জ্ঞান হীন অন্ধকারের গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত থাকবে ? দেখায় যাক না এরা যদি অক্ষর জ্ঞান শিখে , গল্পে উপদেশগুলো পড়ে একটু মানুষ হয় কি না ! তাতে দেশের অবলাগুলো অন্তত শান্তিতে বাঁচতে পারে ।

আমার কালের মেয়েদের কী কোনো সুখ শান্তি ছিল! ঘরের চার দেয়ালের বাইরে যাওয়ার অধিকার তো মূর্খ পুরুষ জাতি গায়ের জোরে কেড়ে নিয়েছিল, শুনেছ তো কত বালবিধবা সমাজের নিষ্ঠুর নিয়মে অকালেই পরপারে পাড়ি দিতে বাধ্য হতো , ভাগ্যিস উদার হৃদয় রামমোহন জন্মেছিলেন এ দেশের মাটিতে ! জান তো কত শত অবলারা মৃত স্বামীর সাথে চিতায় দগ্ধ হয়েছে , ভাবলে গা শিরশিরিয়ে ওঠে ; কী ভয়ানক ছিল সেসব দিন ! কী ভয়ানক নিষ্ঠুর ছিল মানুষ ! না কী অশিক্ষা বশত অজ্ঞতা ? আমি আর তাদের জন্য কী করেছি ? বলতে পারো আমি এসে ঐ সব বাল বিধবাদের কিছুটা সুখের জন্য নতুন করে জীবন শুরু করার সাহস জুগিয়েছি , কিন্তু সেকালে ত আমার পাশে কেউ কেউ দাঁড়ালে – ও শেষ অব্দি আমার পাশের জন চুপিসারে লুকিয়ে পড়েছে , দেখ তো কী ভয়ানক নিষ্ঠুর সমাজ আমাদের! কী পাষাণ হৃদয় এসব মানুষ ! এসব শুনে কী মনে হয় তোমাদের – আমরা সেকালে ভালো ছিলাম ?

হ্যা , একটা মানুষ , সে নিরক্ষর হয়েও মানুষের ওই স্বার্থপর মনটাকে বদলাতে এসেছিল, দক্ষিনেশ্বরে । নদের নিমাই এর মতো সেও ছিল ত্যাগী মানুষ , নিমাই ছিল পন্ডিত , আর এ ছিল অকাট মূখ্য , কিন্তু অন্তর্জ্ঞানী । হ্যাগো ! কত পন্ডিত লোক তার পায়ের তলায় বসে শিক্ষে নিতো । কেশব , মহেন্দ্রলাল , গিরীশ , সিমলার বীরে , আরও কতো পন্ডিতপ্রবর তার কাছে গেলেই মূক হয়ে যেতো , আমিও । কী অসাধারণ ছিল তার বাকবিন্যাস , উপমা , কথা যেন ছবি হয়ে ধরা দিত চোখের সামনে। বারাঙ্গনাদের , নটীদের ওই পাগল ঠাকুর ই তো সমাজে উচ্চাসনে বসিয়েছিল । আজকের মেয়েরা কী সেলেব হতে পারতো সিনেমা থিয়েটারে কাজ করে ! যদি না ওই পুরুত বামুনটি নটী বিনোদিনীদের কাছে টেনে না নিতো ? ভাবতো একবার!

আবার দেখ, এ যুগে জন্মেও কী আমি শান্তি পেতাম! কেন বলছি একথা ? তোমরা ত সব ইংরেজি ভাষার গুনগানেই ব্যস্ত , ছেলে মেয়েদের ইংরেজি ইস্কুলে পড়াচ্ছো , মাতৃভাষা তো তাদের কাছে অধরায় থেকে যাচ্ছে ? মাতৃ দুগ্ধ সম বাংলাভাষা না শিখলে কী জ্ঞানী গুণী হওয়া যায় , একবার ভাব তো ! কেমন অবাঞ্ছিত করে রেখেছো তোমার আপন মাত্তৃসত্তাকে ? এ যেন অনেকটা নিজের জন্মদাত্রীকেই অবহেলায় অসন্মাণে ভিখেরি করে রেখেছো ! ঠুনকো মান সম্মান অর্থ বিত্তের জন্য কেন প্রতারণা করছো নিজের মাতৃভাষাকে ? জানিনা এ অধিকার তোমরা কোথায় থেকে পেলে , এমন পাষাণ হৃদয় নিয়ে বাঁচা যায় , কিন্তু বড় হওয়া যায় কী ! তোমাদের কালে জন্মালে এসব দেখে তো কষ্ট হতো । শুধু কী তাই ? মেয়েদের যোগ্য সম্মান কী তোমরা দিতে পেরেছো ? হামেশাই তো তারা নির্যাতীত ? বলাৎকারের শিকার । পুরুষের আদিম কামনার লোলুপ দৃষ্টির পাশবিকতায় আক্রান্ত , পীড়িত । তোমরা কি ভুলে গেছো বীরের ধর্ম ! হারিয়ে ফেলেছো প্রতিবাদের ভাষা ! ধিক্ তোমাদের ! আমি খুশি হবো যদি তোমরা নির্যাতীতের পাশে দাঁড়িয়ে বিনাশ কর অসুরদের । আমার জন্মদিন পালন তখনই সার্থক হবে যখন দেশ ও জাতি , সমাজের নারীরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করবে।আর আমি পুলকিত হবো তখন , যখন তোমরা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াবে!

আমার অঙ্গের ধুতি চাদর তো তোমরা কবেই ভাসিয়ে দিয়েছো কালের স্রোতে , বাংলা ভাষাও তথৈবচ । সঙ্কুচিত জ্ঞানচর্চা ! আর মনুষ্যত্ব , মাতৃপ্রেম – তার আর এক নাম বৃদ্ধাশ্রম।

Leave a Reply

Logged in as Sushil RudraLog out?

 

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.